ব্যাকরণ শব্দটি সংস্কৃতি থেকে এসেছে। ব্যাকরণকে বলা হয় ভাষার সংবিধান। ব্যাকরণ ভাষার প্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করে এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন, রীতিনীতি শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থাকে। ভাষা নদীর মতো প্রবাহমান। এ প্রবাহই ভাষার প্রাণ। মুখে মুখে ভাষা ব্যবহারে যে পরিবর্তন ঘটে তাতে অনেক নতুন নিয়মের সৃষ্টি হয়। সে নিয়ম কালক্রমে ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাষাকে গতিশীল, জীবন্ত ও প্রাণবন্তকরণে ব্যাকরণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। ভাষা ব্যাকরণকে নয় বরং ব্যাকরণই ভাষাকে অনুসরণ করে। আজকের আর্টিকেলে আমরা ব্যাকরণ কাকে বলে? বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে? পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করব।
ব্যাকরণ কাকে বলে? ব্যাকরণ কি? ব্যকরণের সংজ্ঞা
ব্যাকরণ (বি + আ + √কৃ + অন) শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হলো “বিশেষরূপে বিশ্লেষণ”।সংস্কৃত ভাষায়, “ব্য” মানে “বিশেষ”, “আ” মানে “করতে”, “কৃ” মানে “কাজ” এবং “অন” মানে “অনুসরণ করা”।অর্থাৎ, “ব্যাকরণ” হলো কোন ভাষার শব্দ, বাক্য গঠন এবং নিয়মকানুন বিশ্লেষণ করে বোঝার বিদ্যা। আরও সহজ করে বলতে গেলে, ব্যাকরণ হলো কোন ভাষা সঠিকভাবে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে সম্পর্কে জ্ঞান।
এক কথায় বলা যায়, ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ। বিভিন্ন ব্যাকরণবিদদের মতে ব্যাকরণ হলো –
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে বিদ্যার দ্বারা কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি আলোচিত হয় এবং সেই ভাষার গঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ-রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।”
ডক্টর সুকুমার সেন এর মতে, “যে বইয়ে ভাষার বিচার ও বিশ্লেষণ আছে, তা-ই ব্যাকরণ।”
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “যে শাস্ত্র পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধভাবে বলিতে, পড়িতল ও লিখিতে পারা যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।”
বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে? বাংলা ব্যাকরণ কী?
বাংলা ব্যাকরণ হলো বাংলা ভাষার শব্দ, বাক্য গঠন এবং নিয়মকানুন সম্পর্কে জ্ঞান। যে বিদ্যাশাখায় বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি বর্ণনা করা হয় তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “যে শাস্ত্র জানিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধ রূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাহার নাম বাঙালা ব্যাকরণ।”
সংক্ষেপে বলা যায়,
- শব্দের উৎপত্তি, রূপ, অর্থ সম্পর্কে জানা।
- বাক্য গঠনের নিয়ম সম্পর্কে জানা।
- বিভিন্ন পদের ব্যবহার সম্পর্কে জানা।
- ঠিক-ভুল বাংলা লেখার নিয়ম সম্পর্কে জানা।
বাংলা ব্যাকরণের প্রধান অংশগুলো হল:
- ধ্বনিতত্ত্ব: ধ্বনি, বর্ণ, উচ্চারণ ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা।
- রূপতত্ত্ব: শব্দের রূপ, গঠন, বচন, লিঙ্গ, কাল ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা।
- বাক্যতত্ত্ব: বাক্যের গঠন, পদের ব্যবহার, বাক্যের প্রকারভেদ ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা।
- অর্থতত্ত্ব: শব্দের অর্থ, বাক্যের অর্থ, অলঙ্কার ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা।
বাংলা ব্যাকরণ শেখার গুরুত্ব:
- ভাষা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে।
- লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
- সাহিত্যকর্ম আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করে।
বাংলা ব্যাকরণ শেখার উপায়:
- ব্যাকরণের বই পড়া।
- ব্যাকরণের ক্লাসে ভর্তি হওয়া।
- অনলাইন রিসোর্স ব্যবহার করা।
- নিয়মিত অনুশীলন করা।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা:
ব্যাকরণ হলো যেকোন ভাষার নিয়ম-কানুনের সমষ্টি। কোন ভাষা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সেই ভাষার ব্যাকরণ জানা অপরিহার্য।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
ব্যাকরণ পাঠের মাধ্যমে আমরা:
- শব্দের সঠিক উচ্চারণ ও বানান শিখতে পারি।
- বাক্য গঠনের নিয়মকানুন জানতে পারি।
- বিভিন্ন পদের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারি।
- ঠিক-ভুল বাংলা লেখার নিয়ম শিখতে পারি।
- ভাষা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারি।
- সাহিত্যকর্ম আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।
- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারি।
ব্যাকরণ পাঠ আমাদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
ব্যাকরণ জানলে আমরা:
- সঠিকভাবে কথা বলতে পারি।
- ভুল ছাড়া লেখা লিখতে পারি।
- অন্যের সাথে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করতে পারি।
- বিভিন্ন ধরণের লেখা, যেমন প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প ইত্যাদি লিখতে পারি।
- পরীক্ষা-প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফল করতে পারি।
ব্যাকরণ কত প্রকার ও কি কি?
সাধারণত ব্যাকরণকে চার প্রকারে ভাগ করা হয়:
১) বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ:
- কোন ভাষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে।
- শব্দ, বাক্য এবং পদের বর্তমান রূপ ও ব্যবহার বিশ্লেষণ করে।
- ভাষার নিয়মকানুন বর্ণনা করে।
২) ঐতিহাসিক ব্যাকরণ:
- ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করে।
- কোন ভাষার অতীতের রূপ বিশ্লেষণ করে।
- ভাষার পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে।
৩) তুলনামূলক ব্যাকরণ:
- দুটি বা ততোধিক ভাষার মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য তুলনা করে।
- ভাষাগত সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
- ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়।
৪) দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণ:
- ভাষার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা করে।
- ভাষা ও চিন্তার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
- ভাষার ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করে।
ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় কয়টি ও কি কি?
ব্যাকরণের চারটি প্রধান আলোচ্য বিষয় রয়েছে। এগুলো হলো –
১) ধ্বনিতত্ত্ব:
- ধ্বনি কী, কীভাবে উচ্চারিত হয়, এবং কীভাবে শব্দ গঠনে ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- বর্ণ কী, কত প্রকার, এবং কোন কোন বর্ণ কোথায় ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ এর পার্থক্য, স্বরবর্ণের প্রকারভেদ, ব্যঞ্জনবর্ণের প্রকারভেদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
২) রূপতত্ত্ব:
- শব্দের রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- শব্দের বিভিন্ন রূপ (যেমন: কারকভেদে রূপ পরিবর্তন, বচনভেদে রূপ পরিবর্তন, লিঙ্গভেদে রূপ পরিবর্তন ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করে।
- ক্রিয়াপদের রূপ পরিবর্তন (যেমন: কালভেদে রূপ পরিবর্তন, পুরুষভেদে রূপ পরিবর্তন ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করে।
৩) বাক্যতত্ত্ব:
- বাক্য কী, কীভাবে গঠিত হয়, এবং কীভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- বাক্যের বিভিন্ন অংশ (যেমন: কর্ম, কর্তা, বিশেষণ, ক্রিয়া ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করে।
- বাক্যের প্রকারভেদ (যেমন: সরল বাক্য, যৌগিক বাক্য, মিশ্র বাক্য ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করে।
৪) অর্থতত্ত্ব:
- শব্দের অর্থ কী, এবং কীভাবে বাক্যের অর্থ নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- অলঙ্কার কী, এবং সাহিত্যে অলঙ্কারের ব্যবহার কীভাবে হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
- ভাষার সৌন্দর্য কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করে।
এই চারটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ছাড়াও, ব্যাকরণে আরও কিছু বিষয় আলোচনা করা হয়, যেমন:
- বানান
- ছন্দ
- পদছন্দ
- বক্তৃতামূলক শৈলী
- লেখার নীতি
ব্যাকরণের কাজ কি?
ব্যাকরণের কাজ হলো কোন ভাষার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা।সহজভাবে বলতে গেলে, ব্যাকরণ আমাদেরকে শেখায়:
- কোন ভাষার শব্দগুলো কীভাবে উচ্চারণ করতে হয়।
- কোন ভাষার শব্দের কী অর্থ।
- কোন ভাষায় বাক্য কীভাবে গঠন করতে হয়।
- কোন ভাষায় বিভিন্ন পদের ব্যবহার কীভাবে হয়।
- কোন ভাষায় ঠিক-ভুল লেখার নিয়ম কী।
ব্যাকরণের প্রধান কাজগুলো হল:
- ভাষার স্থায়িত্ব রক্ষা করা: ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনগুলো ভাষাকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। যদি ব্যাকরণের নিয়ম না থাকত, তাহলে ভাষা দ্রুত পরিবর্তিত হত এবং একজনের কাছে যা বোধগম্য হত, তা অন্যজনের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারত।
- ভাষার স্পষ্টতা বৃদ্ধি করা: ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনগুলো ভাষাকে স্পষ্ট ও বোধগম্য করে তোলে। যদি ব্যাকরণের নিয়ম না থাকত, তাহলে ভাষা অস্পষ্ট ও অস্পষ্ট হয়ে পড়ত।
- ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা: ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনগুলো ভাষাকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলে। যদি ব্যাকরণের নিয়ম না থাকত, তাহলে ভাষা রুক্ষ ও অসুন্দর হয়ে পড়ত।
- ভাষা শেখা ও বোঝা সহজ করা: ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনগুলো কোন ভাষা শেখা ও বোঝা সহজ করে তোলে। যদি ব্যাকরণের নিয়ম না থাকত, তাহলে কোন ভাষা শেখা ও বোঝা অনেক কঠিন হয়ে পড়ত।
ব্যাকরণ বিষয়ক গ্রন্থ
বইয়ের নাম / গ্রন্থের নাম | রচয়িতা |
ব্যাকরণ মঞ্জুরী | ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক |
গৌড়ীয় ব্যাকরণ | রাজা রামমোহন রায় |
ব্যাকরণ কৌমুদী | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর |
আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ | জগদীশ চন্দ্র ঘোষ |
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ | মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার |
ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ | ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় |
বাংলা ব্যাকরণ | ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ |
প্রমিত ভাষার বাংলা ব্যাকরণ | রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার |
তাহলে আজ এখানেই শেষ করছি। আশা করি ব্যাকরণ কাকে বলে? বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে? পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।