SC > বিজ্ঞান > রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র কাকে বলে? আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও কাজ

রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র কাকে বলে? আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও কাজ

রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা আইন প্রণয়ন, নিরাপত্তা প্রদান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং সামাজিক সেবা নিশ্চিত করে। এটি জনগণের অধিকার রক্ষা করে এবং প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আজকের আর্টিকেলে আমরা রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র কাকে বলে? আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও কাজ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করব।

রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র মানে কি?

রাষ্ট্র কী: রাষ্ট্র একটি সংগঠিত রাজনৈতিক সত্তা যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার, এবং সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে গঠিত। রাষ্ট্র সাধারণত একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং আইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে, যা জনগণের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  1. ভূখণ্ড (Territory): রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ড বা অঞ্চল থাকে, যা তার সীমান্ত দ্বারা চিহ্নিত হয়। এই ভূখণ্ডে রাষ্ট্রের সরকার কার্যকরী ও আইন প্রণয়ন করে।
  2. জনগণ (Population): রাষ্ট্রের জনগণ হল তার নাগরিক, যারা রাষ্ট্রের আইন, নীতি এবং সেবা গ্রহণ করে। জনগণের সমষ্টি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
  3. সরকার (Government): রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো বা সরকার বিভিন্ন স্তরে (মহান সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি) পরিচালনা করে এবং আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ, এবং বিচারিক কার্যক্রম সম্পাদন করে।
  4. সার্বভৌমত্ব (Sovereignty): রাষ্ট্র নিজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়গুলো স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে এবং অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে।

রাষ্ট্রের উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন: রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি ও কী কী?

রাষ্ট্রের প্রকারভেদ

  1. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (Democratic State): যেখানে জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হয় এবং রাষ্ট্রের সব স্তরের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে।
  2. স্বৈরশাসক রাষ্ট্র (Authoritarian State): যেখানে একটি শক্তিশালী সরকার অথবা একক ব্যক্তি সমস্ত ক্ষমতা দখল করে রাখে এবং জনগণের মতামত সীমিত থাকে।
  3. রাজতন্ত্র (Monarchy): যেখানে রাষ্ট্রের প্রধান ভূমিকা একটি রাজা বা রানি পালন করে এবং শাসন ব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবে রাজবংশীয় হয়।
  4. ফেডারেল রাষ্ট্র (Federal State): যেখানে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার মিলে রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা করে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
  5. একক রাষ্ট্র (Unitary State): যেখানে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে এবং স্থানীয় প্রশাসন সরকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হয়।

রাষ্ট্রের ভূমিকা

  • আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ: রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এবং তার কার্যকরী প্রয়োগ নিশ্চিত করে।
  • নিরাপত্তা প্রদান: রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো জনগণ ও ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • সেবা প্রদান: রাষ্ট্র স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও অন্যান্য মৌলিক সেবা প্রদান করে।
  • অর্থনৈতিক কার্যক্রম: রাষ্ট্র অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরি করে এবং দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করে।

রাষ্ট্র হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা যা জনগণের জীবন পরিচালনা করে, নিরাপত্তা প্রদান করে এবং মৌলিক সেবা নিশ্চিত করে। এটি সরকার, ভূখণ্ড, জনগণ এবং সার্বভৌমত্বের একটি সংমিশ্রণ, যা সমাজের উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক।

রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

রাষ্ট্র নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামত এবং সংজ্ঞা তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজতাত্ত্বিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে কিছু প্রখ্যাত দার্শনিকের রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হলো:

১. প্লেটো (Plato)

প্লেটো তার “গণতন্ত্র” (Republic) গ্রন্থে রাষ্ট্রকে একটি আদর্শ সমাজ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তার মতে, রাষ্ট্র হলো একটি স্বাভাবিক সংগঠন যা মানুষের ন্যায় ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। তিনি রাষ্ট্রকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন: শাসক (রাজা), রক্ষক (সেনা), এবং উৎপাদক (কৃষক ও ব্যবসায়ী)। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো এই শ্রেণীগুলোর সমন্বয়ে ন্যায়পরায়ণতা এবং সমাজের সুস্থতা অর্জন।

২. অ্যারিস্টটল (Aristotle)

অ্যারিস্টটল তার “পলিটিক্স” (Politics) গ্রন্থে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দেন। তার মতে, রাষ্ট্র একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা মানুষের ভালো জীবনযাপন নিশ্চিত করে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি ফলস্বরূপ, এবং এটি ন্যায় ও মেধার ভিত্তিতে গঠিত। অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরণ উল্লেখ করেন, যেমন গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, এবং স্বৈরশাসন।

৩. থোমাস হবস (Thomas Hobbes)

থোমাস হবস তার “লেভিয়াথান” (Leviathan) গ্রন্থে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান করেন। তার মতে, রাষ্ট্র হলো একটি চুক্তির ফলস্বরূপ যা মানুষের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। Hobbes বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে সমাজের বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত দূর করে। তার মতে, রাষ্ট্রের প্রধান ভূমিকা হলো জনগণের নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা।

৪. জন লক (John Locke)

জন লক তার “টু ট্রিটিস অব গভর্নমেন্ট” (Two Treatises of Government) গ্রন্থে রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তার মতে, রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকার, যেমন জীবন, স্বাধীনতা, এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্য গঠিত হয়। লক বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে চলে এবং জনগণ যদি রাষ্ট্রের দ্বারা প্রদত্ত অধিকার ক্ষুন্ন হয়, তবে তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে।

৫. জিন-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)

জিন-জাক রুশো তার “দ্য সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট” (The Social Contract) গ্রন্থে রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন। রুশো বলেছেন যে, রাষ্ট্র হলো জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত এবং এটি জনগণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। তার মতে, সমাজের ন্যায় ও সমতার জন্য “সাধারণ ইচ্ছা” (General Will) অনুসরণ করা উচিত।

৬. কার্ল মার্ক্স (Karl Marx)

কার্ল মার্ক্স রাষ্ট্রকে একটি শ্রেণী সংগ্রামের উপকরণ হিসেবে দেখেছিলেন। তার মতে, রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্র যা শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের গঠন ও কার্যক্রম প্রধানত অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণী সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়। তিনি মনে করতেন যে, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।

৭. ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)

ম্যাক্স ওয়েবার রাষ্ট্রকে “একচেটিয়া সহিংসতার বৈধ অধিকার” (monopoly on legitimate violence) হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তার মতে, রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এর ক্ষমতা আইনগতভাবে সহিংসতা প্রয়োগের ক্ষমতা, যা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি প্রয়োগ করতে পারে না।

বিভিন্ন দার্শনিকদের রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হলেও, সকলের মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে: রাষ্ট্র সমাজের সংহতি, শৃঙ্খলা, এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিভিন্ন ধারণাগুলি রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যক্রম ও কাঠামো বুঝতে সহায়ক এবং রাজনৈতিক তত্ত্বের বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।

আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি কাঠামোকে চিহ্নিত করে, যা তাকে ঐতিহাসিক ও প্রাচীন রাষ্ট্রগুলো থেকে আলাদা করে। আধুনিক রাষ্ট্রের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১. সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)

আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হলো তার ক্ষমতার স্বায়ত্তশাসন, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এটি অর্থাৎ, একটি রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক বিষয়গুলো নিজের কর্তৃত্বাধীন রাখে এবং অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে।

২. আইনগত কাঠামো (Legal Framework)

আধুনিক রাষ্ট্রে একটি সুসংগঠিত আইনি কাঠামো থাকে, যা রাষ্ট্রের আইন, বিধি ও বিধানসমূহ নির্ধারণ করে। এই আইনি কাঠামো আইন আদালত, আইন প্রণেতা, এবং আইনি ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি নাগরিকদের অধিকার, দায়িত্ব, এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে।

৩. জনগণের অংশগ্রহণ (Public Participation)

আধুনিক রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

৪. পরিচালনাগত ব্যবস্থা (Administrative System)

আধুনিক রাষ্ট্রে একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো থাকে, যা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইত্যাদি।

৫. অর্থনৈতিক কাঠামো (Economic System)

আধুনিক রাষ্ট্রের একটি নির্ধারিত অর্থনৈতিক কাঠামো থাকে, যা বাজার অর্থনীতি, পরিকল্পিত অর্থনীতি, অথবা মিশ্র অর্থনীতি হতে পারে। এটি রাজস্ব সংগ্রহ, বাজেট প্রণয়ন, এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা নির্ধারণ করে।

৬. সামাজিক সেবা (Social Services)

আধুনিক রাষ্ট্র সামাজিক সেবা প্রদান করে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, এবং পরিবহন। এই সেবাগুলি জনগণের জীবনের মান উন্নত করতে সহায়ক এবং সামাজিক সমতা নিশ্চিত করে।

৭. সাংবিধানিক কাঠামো (Constitutional Framework)

আধুনিক রাষ্ট্রে একটি সাংবিধানিক কাঠামো থাকে যা রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, অধিকার, এবং শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করে। সাংবিধানিক চুক্তি বা সংবিধান রাষ্ট্রের আইনি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

৮. রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি (International Recognition)

আধুনিক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে স্বীকৃত হয় এবং বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ লাভ করে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

৯. সংস্কৃতিগত ঐক্য (Cultural Unity)

আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকরা সাধারণ সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, এবং ঐতিহ্যগত ঐক্য দ্বারা সংযুক্ত থাকে। এটি রাষ্ট্রের সামাজিক সংহতি এবং জাতীয় পরিচিতি বজায় রাখে।

১০. প্রযুক্তির ব্যবহার (Use of Technology)

আধুনিক রাষ্ট্রে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়, যা প্রশাসন, যোগাযোগ, এবং জনগণের সেবা উন্নত করতে সহায়ক। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং তথ্য প্রযুক্তি রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে দ্রুত ও দক্ষ করে তোলে।

আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি এর রাজনৈতিক, আইনি, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে চিহ্নিত করে এবং এটি একটি সুশৃঙ্খল, কার্যকরী, এবং সমন্বিত সমাজ গঠনে সহায়ক। আধুনিক রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলি জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাষ্ট্র কি ধরণের প্রতিষ্ঠান?

রাষ্ট্র একটি মৌলিক ও সর্বজনীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা, সেবা, এবং স্বশাসন নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:

১. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Political Institution)

রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যা শাসনব্যবস্থা, আইন প্রণয়ন, এবং নীতি নির্ধারণ করে। এটি সরকারের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেমন নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ।

২. আইনি প্রতিষ্ঠান (Legal Institution)

রাষ্ট্র একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে যা আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ, এবং বিচারকার্য পরিচালনা করে। এটি নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করে।

৩. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Economic Institution)

রাষ্ট্র অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে, বাজেট প্রণয়ন করে এবং আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি রাজস্ব সংগ্রহ করে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন করে, এবং জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেবা প্রদান করে।

৪. সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social Institution)

রাষ্ট্র সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে কাজ করে, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা। এটি সামাজিক সেবা প্রদান করে এবং নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক।

৫. শাসন ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান (Administrative Institution)

রাষ্ট্র প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি স্থানীয়, আঞ্চলিক, এবং কেন্দ্রীয় স্তরের প্রশাসনিক কার্যক্রম সমন্বয় করে।

৬. আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (International Institution)

রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি পরিচালনা করে। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

৭. বংশগত ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান (Cultural and Traditional Institution)

রাষ্ট্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করে এবং নাগরিকদের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও ঐক্যের জন্য কাজ করে।

রাষ্ট্র একাধিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা রাজনৈতিক, আইনি, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে একটি সম্মিলিত এবং সুসংহত সত্তা হিসেবে পরিচালনা করে। এটি নাগরিকদের নিরাপত্তা, উন্নয়ন, এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাষ্ট্র এর কাজ কি?

রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ এবং দায়িত্ব থাকে যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেবা এবং পরিচালনা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রের প্রধান কাজগুলো নিম্নরূপ:

১. আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ (Legislation and Enforcement)

রাষ্ট্র নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং বিদ্যমান আইনগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এটি আইন আদালত, আইন প্রণেতা, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করে এবং নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করে।

২. নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা (Security and Law Enforcement)

রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে। এটি পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি মোকাবেলা করে এবং অপরাধ দমন করে।

৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development)

রাষ্ট্র অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে, বাজেট তৈরি করে, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এটি রাজস্ব সংগ্রহ করে, বাজেট ব্যয় করে এবং জনগণের অর্থনৈতিক সেবা ও সুবিধা প্রদান করে।

৪. সামাজিক সেবা প্রদান (Provision of Social Services)

রাষ্ট্র স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা প্রদান করে। এটি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি ও প্রকল্প পরিচালনা করে।

৫. শাসন ও প্রশাসন (Governance and Administration)

রাষ্ট্র প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি স্থানীয়, আঞ্চলিক, এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করে এবং সেবা প্রদান করে।

৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি (International Relations and Diplomacy)

রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি ও চুক্তি সম্পাদন করে। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করে।

৭. নাগরিক অধিকার ও মুক্তি (Protection of Rights and Freedoms)

রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে। এটি মানবাধিকার রক্ষা করে এবং নাগরিকদের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানায়।

৮. পরিবেশ সুরক্ষা (Environmental Protection)

রাষ্ট্র পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রকৃতি সুরক্ষার জন্য নীতিমালা তৈরি করে। এটি দূষণ নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত সচেতনতা প্রচারের জন্য কাজ করে।

৯. জাতীয় ঐক্য ও সংস্কৃতি (National Unity and Culture)

রাষ্ট্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার জন্য কাজ করে। এটি জনগণের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করে এবং জাতীয় পরিচয়কে শক্তিশালী করে।

শেষকথা

রাষ্ট্রের কাজগুলো সমাজের বিভিন্ন দিককে সংহত ও সুসংহত করতে সহায়ক। এটি আইনি, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক, এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে, যা জনগণের কল্যাণ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top