গ্রহ হলো একটি মহাজাগতিক বস্তু, যা নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে। সৌরজগতে ৮টি গ্রহ আছে: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন।
গ্রহ কাকে বলে?
গ্রহ হল একটি মহাজাগতিক বস্তু, যা একটি নক্ষত্র বা তার অবশিষ্টাংশের চারপাশে ঘোরে এবং নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য গোলাকার আকার ধারণ করে। গ্রহগুলো সাধারণত পর্যাপ্ত ভর ধারণ করে যাতে তারা তাদের নিজের মহাকর্ষবল দ্বারা নিজস্ব কক্ষপথের আশেপাশের অন্যান্য বস্তুগুলোকে সরিয়ে ফেলতে পারে। গ্রহগুলো নিজের আলো উৎপন্ন করতে পারে না; বরং তারা যে নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে, তার আলো প্রতিফলিত করে।
আরও পড়ুন: গ্যালাক্সি কাকে বলে? গ্যালাক্সি ও ছায়াপথ এর মাঝে পার্থক্য কী?
সৌরজগতের গ্রহ কয়টি ও কি কি? ও তাদের নাম
আমাদের সৌরজগতে মোট আটটি গ্রহ রয়েছে। এরা সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে এবং প্রত্যেকটি গ্রহের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সৌরজগতের এই আটটি গ্রহ হল:
- বুধ (Mercury): সূর্যের সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে ছোট গ্রহ। এটি বায়ুমণ্ডল প্রায় নেই বললেই চলে, এবং এর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল।
- শুক্র (Venus): সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ। এটি আকার এবং গঠনে পৃথিবীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে এর বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত ঘন এবং গরম।
- পৃথিবী (Earth): তৃতীয় গ্রহ এবং একমাত্র গ্রহ যেখানে জীবন বিদ্যমান। এটি সমুদ্র, বায়ুমণ্ডল, এবং ভূত্বক নিয়ে গঠিত।
- মঙ্গল (Mars): চতুর্থ গ্রহ, যা তার লাল রঙের জন্য “লাল গ্রহ” নামে পরিচিত। এখানে পৃথিবীর মতোই ঋতু, মেরু বরফ এবং বিশাল অগ্নেয়গিরি রয়েছে।
- বৃহস্পতি (Jupiter): পঞ্চম এবং বৃহত্তম গ্রহ। এটি একটি গ্যাস দৈত্য এবং এর ৭৯টি চাঁদ রয়েছে, যার মধ্যে গ্যানিমিড সবচেয়ে বড়।
- শনি (Saturn): ষষ্ঠ গ্রহ, যা তার শ্বাসরুদ্ধকর রিং সিস্টেমের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি গ্যাস দৈত্য এবং এর বহু চাঁদ রয়েছে।
- ইউরেনাস (Uranus): সপ্তম গ্রহ এবং এটি তার পাশে ঘূর্ণায়মান একমাত্র গ্রহ। এটি একটি বরফ দৈত্য এবং এর বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, এবং মিথেন দ্বারা গঠিত।
- নেপচুন (Neptune): অষ্টম এবং সবচেয়ে দূরের গ্রহ। এটি একটি বরফ দৈত্য এবং এর শক্তিশালী বাতাস ও ঝড়ের জন্য পরিচিত।
সূর্যের নিকটতম গ্রহ কোনটি?
সূর্যের নিকটতম গ্রহ হলো বুধ (Mercury)। এটি সৌরজগতের প্রথম এবং সবচেয়ে ছোট গ্রহ, যা সূর্যের চারপাশে ঘোরে। বুধের কক্ষপথের দূরত্ব সূর্য থেকে গড়ে প্রায় ৫৭.৯ মিলিয়ন কিলোমিটার (৩৫.৯৮ মিলিয়ন মাইল)। কারণ বুধ সূর্যের এত কাছাকাছি অবস্থিত, তাই এর পৃষ্ঠতলে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি পরিবর্তিত হয়, দিনে খুব বেশি গরম এবং রাতে অত্যন্ত ঠান্ডা হয়।
পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ কোনটি?
পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ হলো শুক্র (Venus)। শুক্র গ্রহটি আকার, গঠন এবং অবস্থানে পৃথিবীর সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই একে প্রায়ই “পৃথিবীর যমজ” বলা হয়। শুক্র এবং পৃথিবী সাধারণত একে অপরের নিকটতম গ্রহ, যদিও কখনও কখনও মঙ্গল গ্রহ (Mars) পৃথিবীর কাছাকাছি আসতে পারে, তবে বেশিরভাগ সময়েই শুক্রই পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ হিসেবে পরিচিত।
সবচেয়ে ছোট গ্রহ কোনটি?
সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহ হলো বুধ (Mercury)। এটি আকারে ছোট এবং সৌরজগতের প্রথম গ্রহ হিসেবে সূর্যের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। বুধের ব্যাস প্রায় ৪,৮৭৯ কিলোমিটার (প্রায় ৩,০৩২ মাইল), যা একে আকারে এবং ভরে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট করে তুলেছে।
আরও পড়ুন: নক্ষত্র কাকে বলে? নক্ষত্র কয়টি ও কি কি?
সবচেয়ে বড় গ্রহ কোনটি?
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ হলো বৃহস্পতি (Jupiter)। এটি সৌরজগতের পঞ্চম গ্রহ এবং সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে প্রথম গ্যাস দৈত্য। বৃহস্পতির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:
বৃহস্পতির বৈশিষ্ট্য
- আকার ও ভর: বৃহস্পতি সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ, যার ব্যাস প্রায় ১৪৩,০০০ কিলোমিটার (৮৮,৮৪৬ মাইল)। এর ভর পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৩১৮ গুণ বেশি, যা সমগ্র সৌরজগতের গ্রহগুলোর মোট ভরের দুই তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি।
- গঠন: বৃহস্পতি মূলত গ্যাস এবং তরল দ্বারা গঠিত। এর প্রধান উপাদান হলো হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম, যা সূর্যের গঠনও নির্ধারণ করে। এটি একটি পাথুরে কেন্দ্র থাকতে পারে, তবে এর মূল অংশ এখনও পুরোপুরি নির্ধারণ করা যায়নি।
- বায়ুমণ্ডল: বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন, অ্যামোনিয়া, এবং অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি। এখানে খুব শক্তিশালী ঝড় এবং বাতাস দেখা যায়, যা গ্যাসের মেঘের স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বিখ্যাত ঝড় হলো “গ্রেট রেড স্পট,” যা একটি বিশাল এবং দীর্ঘস্থায়ী ঝড়।
- চাঁদ: বৃহস্পতির চারপাশে ৭৯টি চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে চারটি প্রধান চাঁদ (আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, এবং ক্যালিস্টো) “গ্যালিলেয়ান মুন” নামে পরিচিত। গ্যানিমিড বৃহস্পতির সবচেয়ে বড় চাঁদ এবং এটি সৌরজগতের সবচেয়ে বড় চাঁদ।
- চৌম্বক ক্ষেত্র: বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী, যা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তুলনায় প্রায় ২০,০০০ গুণ বেশি। এর চৌম্বক ক্ষেত্রটি বিভিন্ন রকমের চার্জকৃত কণাকে আটকাতে পারে, যা বৃহস্পতির চারপাশে একটি চৌম্বকীয় বলয় তৈরি করে।
- রিং সিস্টেম: বৃহস্পতির চারপাশে একটি দুর্বল, কিন্তু বিস্তৃত রিং সিস্টেম রয়েছে, যা প্রধানত ধূলিকণার দ্বারা গঠিত। যদিও এই রিং সিস্টেমটি শনির মতো বিশিষ্ট নয়, তবুও এটি বৃহস্পতিকে অনন্য করে তোলে।
বৃহস্পতি তার বিশাল আকার, জটিল বায়ুমণ্ডল, এবং শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য সৌরজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় গ্রহগুলির মধ্যে একটি।
মহাবিশ্বে কয়টি গ্রহ আছে?
মহাবিশ্বে কতটি গ্রহ রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা জানা অসম্ভব। মহাবিশ্ব অত্যন্ত বিশাল এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কৃত হচ্ছে। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির (আকাশগঙ্গা) মধ্যেই শত শত বিলিয়ন গ্রহ থাকতে পারে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- এক্সোপ্ল্যানেট: আমাদের সৌরজগতের বাইরে যে গ্রহগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তাদের এক্সোপ্ল্যানেট বলা হয়। এখন পর্যন্ত হাজার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হয়েছে, যা অন্য নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে।
- মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি সংখ্যা: মহাবিশ্বে প্রায় ২ ট্রিলিয়নেরও বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যদি প্রতিটি গ্যালাক্সিতে কয়েকশো বিলিয়ন নক্ষত্র থাকে, তাহলে সেই গ্যালাক্সিগুলিতে আরও অসংখ্য গ্রহ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
- প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা: বর্তমান প্রযুক্তি কেবলমাত্র আমাদের কাছাকাছি থাকা গ্রহগুলি আবিষ্কার করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরও অনেক গ্রহ আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
মহাবিশ্বে গ্রহের সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব না হলেও এটি নিশ্চিত যে গ্রহের সংখ্যা অসংখ্য এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার হচ্ছে। মহাবিশ্বের বিশালতা এবং এর বৈচিত্র্য আমাদের কল্পনারও বাইরে।
শেষকথা
সৌরজগতের এই আটটি গ্রহ সূর্যের চারপাশে স্থিতিশীল কক্ষপথে ঘুরছে, এবং প্রতিটি গ্রহের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গ্রহগুলো আমাদের মহাবিশ্বের জটিলতা এবং বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এসব গ্রহ নিয়ে গবেষণা এবং আবিষ্কার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের জন্য এক চিরন্তন অনুসন্ধানের বিষয়।